রতন টাটার মৃত্যুতে টাটা গ্রুপের পরিবর্তনের সাথে বিশেষ যত্ন পাবে এক কুকুর!
রতন টাটা মারা গেছেন গত মাসের ৯ তারিখে। তাঁর মৃত্যু একটি যুগের অবসান ঘটিয়েছে। তিনি ছিলেন ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিল্পপতিদের একজন। রতন টাটার মৃত্যুর পর টাটা গ্রুপ এবং বিশাল এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মূল নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান টাটা ট্রাস্টস বেশ কিছু পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, যাঁদের তিনি ভালোবাসাতেন, মৃত্যুর আগে রতন টাটা তাঁদের জন্য উদারহস্তে অর্থকড়ির ব্যবস্থা করে গেছেন। এর মধ্যে যেমন মানুষ আছে, আছে তাঁর প্রিয় কুকুরও।
টাটা গ্রুপকে তিনি এমন এক কোম্পানিতে রূপান্তরিত করেছেন, যেটি এখন একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি এবং যা মানুষের উপকারের জন্য বিভিন্ন রকম দাতব্য কর্মকাণ্ড চালায়। মানবহিতৈষী এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় টাটা ট্রাস্টসের অধীনে, যেটি আবার টাটা সন্সের ৬৬ শতাংশ শেয়ারের মালিক। অর্থাৎ টাটাদের আয়ের একটি বড় অংশই চলে যায় জনসেবায়।
টাটা গোষ্ঠীর নতুন মুখ নোয়েল টাটা
রতন টাটার মৃত্যুর পর টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান তাঁর সৎভাই নোয়েল টাটা। টাটাদের জগতে তিনি সম্মানিত, তবে একটু চুপচাপ ধরনের মানুষ। রতন টাটার উল্টো। টাটা গ্রুপে তিনি ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, যার মধ্যে ছিল টাটা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং টাটা স্টিল ও টাইটানের ভাইস চেয়ারম্যানের পদে দায়িত্ব পালন। টাটা গ্রুপের খুচরা ব্যবসার প্রসার ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থিতির পেছনে নোয়েল টাটার অবদান রয়েছে।
নোয়েল টাটাকে এমন সময় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যখন টাটা ট্রাস্ট এমন একজনকে খুঁজছিল, যিনি নেতৃত্ব দিয়ে টাটাদের ঐতিহ্য ও জনহিতৈষী কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে পারবেন। তাঁর নেতৃত্ব দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রসার কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নেবে, এমনটাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
পালাবদল ও পারিবারিক ঐতিহ্য
উত্তরাধিকারী হিসেবে নোয়েল টাটাকে বেছে নেওয়ার ফলে কেবল টাটাদের পরম্পরা বজায় থাকছে, তা নয়। বরং রতন টাটার দর্শনকেও এর মাধ্যমে সম্মান দেখানো হয়েছে।
নোয়েলের পাশাপাশি তাঁর সন্তানদেরও সামনে নিয়ে এসেছে টাটা ট্রাস্ট। তাঁর ছেলে নেভিল ২০১৬ সাল থেকে স্টার বাজার পরিচালনা করছেন। আর দুই মেয়ে লিয়া ও মায়া টাটার বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন। তাঁরাই এখন টাটা গ্রুপের নতুন প্রজন্ম এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটির মধ্যে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে চলে এসেছেন।
এর বাইরে পরিবারের বিশ্বস্ত ও দীর্ঘদিনের সহযোগী মেহলি মিস্ত্রিকে টাটা ট্রাস্টে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রতন টাটার কাছ থেকে তিনি শক্ত সমর্থন পেয়েছিলেন। ফলে টাটা ট্রাস্টে তাঁর ভূমিকা ধীরে ধীরে বেড়েছে।
টাটা মোটরসের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা
পি বি বালাজি হলেন টাটা মোটরসের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা। ৫৪ বছর বয়সী এই ব্যক্তি টাটা গ্রুপে এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি বেশ কুশলী, আর্থিক বিষয়ে তাঁর দক্ষতা রয়েছে। ফলে তিনি চেয়ারম্যান এন চন্দ্রশেখরানের সমর্থন পেয়েছেন। হিন্দুস্তান ইউনিলিভার থেকে ২০১৭ সালে তিনি টাটা মোটরসে যোগ দেন। এরপর টাটার কেবল উন্নতি ঘটেছে।
বালাজির নেতৃত্বের ফলে টাটা মোটরস ২০২৩–২৪ অর্খবছরে রেকর্ড ৪ দশমিক ৩৮ লাখ কোটি রুপি আয় করে। ভারতীয় ব্যবসার জগতে যে কৃতিত্ব বিরল, সেই ঋণমুক্ত থাকার কৃতিত্বও পেয়েছে এই কোম্পানি। আর তাদের হাতে নগদ অর্থ রয়েছে ১ হাজার কোটি রুপি।
এত সব আর্থিক সাফল্যের পর পি বি বালাজিকে আরও বেশি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন এয়ার ইন্ডিয়া, টাইটান, টাটা টেকনোলজিস ও টাটা কনজ্যুমারের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। তিনি টাটা মোটরসের বাণিজিক ও যাত্রীবাহী যানবাহনের ব্যবসাকে আলাদা করতে কাজ করছেন। অন্যদিকে একীভূত হবে টাটা মোটরস ফাইন্যান্স ও টাটা ক্যাপিটাল। গ্রুপের ভবিষ্যৎ আর্থিক গতিপথ তিনিই ঠিক করে দিচ্ছেন।
রতন টাটার উইল ও কুকুর
মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পরে রতন টাটার উইল জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছিল। তাতে তাঁর উদারতা প্রকাশ পেয়েছে। নিজের কর্মী, বন্ধুদের জন্য তিনি অর্থ রেখে গেছেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো জার্মান শেফার্ড কুকুর টিটোর জন্য তাঁর ভালোবাসা। কুকুর তিনি ভালোবাসতেন। তাই তিনি নিশ্চিত করেছেন টিটো যেন ‘অসীম’ যত্ন পায়। এই দায়িত্ব তিনি দিয়ে গেছেন রাঁধুনি রাজন শকে।
রতন টাটার নির্বাহী সহকারী ছিলেন শান্তনু নাইডু। বয়স্কদের সঙ্গ দেওয়ার প্রতিষ্ঠান গুডফেলোস প্রতিষ্ঠার সময় তিনি রতন টাটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। শান্তনু নাইডুর বিদেশে পড়াশোনার খরচ আসবে রতন টাটার সম্পদ থেকে।
মুম্বাইয়ের জুহু তারা রোডের আলিবাগে অবস্থিত দুই হাজার বর্গফুটের সমুদ্রের কাছের বাড়ি এবং তাঁর সব বিলাসবহুল গাড়ি রতন টাটার সম্পদের তালিকায় স্থান পেয়েছে। গাড়িগুলোর নিলাম হতে পারে কিংবা তা টাটা গ্রুপের জাদুঘরেও জায়গা পেতে পারে।
জনসেবায় বিপুল ব্যয়
রতন টাটা কেবল ব্যবসায়ীই ছিলেন না। জনহিতৈষী কাজে তিনি সময় ও অর্থ ব্যয় করেছেন। টাটা সন্স ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তাঁর যে মালিকানা রয়েছে, তা এখন চলে যাবে রতন টাটা এনডাওমেন্ট ফাউন্ডেশনে। এই ফাউন্ডেশন শিক্ষা, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এক যুগের শেষ, নতুন যুগের শুরু
রতন টাটার মৃত্যু কেবল একটি যুগের অবসান ঘটিয়েছে তা নয়, বরং টাটা গ্রুপে তা নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তাঁর উত্তরাধিকার নোয়েল টাটা ইতিমধ্যে টাটা ট্রাস্টের ভবিষ্যৎ গন্তব্য নির্ধারণের কাজ শুরু করেছেন। এক শতকের বেশি সময় ধরে যে ঐতিহ্য টাটা গ্রুপ লালন করছে, তাকে সম্মান করেই হবে নতুন যাত্রা। পাশাপাশি টাটাদের নতুন প্রজন্ম এখন আরও বেশি দায়িত্বপূর্ণ কাজ পাচ্ছেন।