হিযবুল বাহার; বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্ন্তজাতিক যাত্রীবাহী জাহাজের ইতিহাস
বাংলাদেশের বর্তমানে কোন সমুদ্রগামী আর্ন্তজাতিক যাত্রীবাহী জাহাজ নেই। তবে আশির দশকে ‘হিযবুল বাহার’ নামের একটি আর্ন্তজাতিক যাত্রীবাহী জাহাজের মালিক ছিলো বাংলাদেশ।
১৯৫৩ সালে GENERAL MANGIN নামে একটি প্যাসেঞ্জার শীপ নির্মিত হয় ফ্রান্সের সেন্ট-নাজারিতে, তখন এটি ফ্রান্সের মারসেলি থেকে পশ্চিম আফ্রিকার ফ্রেঞ্চ উপনিবেশ অংশে চলাচল করতো। কালক্রমে ১৯৬৯ সালে ফিলিপাইনে বিক্রি হয়ে President নাম ধারণ করে এবং ম্যানিলা থেকে জাপান রুটে চলতো, এরপর ১৯৭২ সালে পানামার পতাকা ধারণ করে Estern Queen নামে সিঙ্গাপুর থেকে অষ্ট্রেলিয়ার ফ্রিমেন্টলে যাত্রী পরিবহন করতো জাহাজটি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হজযাত্রা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় বাংলাদেশি পরিচয়ে হজে যাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশিদের ভারতের পাসপোর্ট নিয়ে হজে যেতে হয়েছিল। ভারতীয় জাহাজ ‘মুহাম্মদী’তে করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হজযাত্রী পরিবহন করা হতো তখন। অন্যদিকে লটারির মাধ্যমে ৩ হাজার হজযাত্রী বাছাই করে বিমানযোগে ঢাকা থেকে পাঠানো হয়।
‘মুহাম্মদী’ জাহাজটি বেশ পুরোনো ও দুর্বল হওয়ায় তা সমুদ্রপথে যাতায়াতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সে জন্য সেটি বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু ‘হিজবুল বাহার’ নামে আরেকটি জাহাজ কেনার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে ক্রয়সূত্রে ‘হিযবুল বাহারের’ মালিক হয় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন।
এ প্রসঙ্গে ‘পবিত্র হজ কার্যক্রম-২০২৩’ উদ্বোধনকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন,
‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কম খরচে হজ পালনের জন্য তিনি ‘হিযবুল বাহার’ জাহাজ কেনেন এবং বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে হজযাত্রী পাঠান।’
চার বছর এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলার পর ১৯৮১তে বাংলাদেশ নেভিকে হস্তান্তর করা হলে ‘শহীদ সালাহউদ্দিন’ নাম ধারণ করে। সে বছরের ১৯ থেকে ২১ জানুয়ারি তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের সেরা ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এবং এক দল বিজ্ঞানীকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রগামী যাত্রীবাহী জাহাজ ‘হিযবুল বাহার’-এ চড়ে বঙ্গোপসাগরে একটি ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষা সফর তথা সমুদ্র অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনা ও উদ্যোগে ‘সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’ এই শিক্ষা সফরের আয়োজন করে। এই সমুদ্র অভিযান বা শিক্ষা সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমত, দেশের সেরা ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, অথচ অপরিচিত বঙ্গোপসাগরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ও সম্ভাবনাকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবহিত করা।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, সমুদ্রবিজ্ঞানের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত গবেষণাকাজে সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। যাত্রীবাহী ‘হিযবুল বাহার’ ছাড়াও সামুদ্রিক অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ নৌবাহিনীর চারটি জাহাজ এই সমুদ্র অভিযানে অংশগ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার সেরা ছাত্র-ছাত্রী ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে দুই রাত, এক দিন বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করার পরিকল্পনা নিয়ে সারা দেশে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। তখন পত্রপত্রিকার শিরোনাম দখল করে এই কার্যক্রম। আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে।
৫৩১ ফুট লম্বা জাহাজটির ১২৪৭৫ গ্রোস টনেজ ছিলো যার বারমিষ্টার এন্ড ওয়েইন ডিজেল ইঞ্জিন ৯৬০০ Bhp শক্তির যোগানে ১৬ নট গতিতে চলতে সক্ষম ছিলো। ৫৮০ জন কেবিনে এবং ১৫৬ জনের ডরমেটরিতে থাকার ব্যবস্থা ছিলো। জাহাজটিতে মোট ১৬৮ জন ক্রু কর্মরত থাকতো।
আকাশপথে হাজিদের ভ্রমণ নাগালের মধ্যে এসে যাওয়ায় ১৯৮১ সালের কয়েক বছর আগে থেকে জাহাজটি কার্যত অব্যবহৃত অবস্থায় ছিল। বিক্রি করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত জাহাজটিকে সচল রাখার জন্য প্রতি তিন মাসে একবার বঙ্গোপসাগরে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত চালাতে হতো। ১৯৮৫ সালে এটি তৈরীর ৩২ বছর পর চট্টগ্রামে স্ক্রাপ করে ফেলা হয়। সেই সাথে সমাপ্ত হয় বাংলাদেশের দুই শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদের ছোঁয়া পাওয়া একমাত্র সমুদ্রগামী আর্ন্তজাতিক জাহাজ ‘হিযবুল বাহার’ এর অধ্যায়।
-কামরুল ইসলাম রুবেল
ON/RBL