দেশে তৈরি মোবাইল ফোন বিদেশে রপ্তানির অপার সম্ভাবনা
মোবাইল হ্যান্ডসেট খাত সংশ্লিষ্টদের থেকে জানা যায়, স্মার্টফোন ও ফিচার ফোন মিলিয়ে দেশে বার্ষিক প্রায় পাঁচ কোটি মোবাইল হ্যান্ডসেটের চাহিদা রয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে দেশীয় ও বহুজাতিক মিলিয়ে বর্তমানে মোট ১৭টি ব্র্যান্ড দেশেই মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজন ও উৎপাদন করছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী স্মার্টফোন ও ফিচার ফোন মিলিয়ে দেশে বার্ষিক মোবাইল হ্যান্ডসেটের যে চাহিদা রয়েছে তার বাজারমূল্য প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে এই খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের। এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়িয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাজস্বও পাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
বর্তমানে দেশে হ্যন্ডসেটের মোট চাহিদার প্রায় শতভাগই স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে এবং শুধুমাত্র কিছু প্রিমিয়াম ও ফ্লাগশিপ হ্যান্ডসেট আমদানি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্র্যান্ড নেপাল ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে সীমিত আকারে হ্যান্ডসেট রপ্তানিও শুরু করেছে। এখন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ব্যাপকভাবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ মোবাইল হ্যান্ডসেট রপ্তানির। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছে যার মধ্যে ৪৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশের মোবাইল হ্যান্ডসেট শিল্পের পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতাকে কাজে লাগানো গেলে তৈরি পোশাক, মৎস্যজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্যের পাশাপাশি মোবাইল হ্যান্ডসেটও হয়ে উঠতে পারে রপ্তানি আয়ের অন্যতম মাধ্যম।
ইন্টারন্যাশনাল ডেটা করপোরেশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে বার্ষিক মোবাইল হ্যান্ডসেটের চাহিদার মোট বাজারমূল্য প্রায় ৫২৭ বিলিয়ন ডলার। মোট উৎপাদিত মোবাইল হ্যান্ডসেটের ৯৩ শতাংশই উৎপাদন করছে চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ যদি বৈশ্বিক হ্যান্ডসেট চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশও রপ্তানি করতে পারে তাহলে এই খাত থেকে বার্ষিক রপ্তানি আয় হতে পারে প্রায় ২৬ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। দেশের মোবাইল হ্যান্ডসেট রপ্তানির সম্ভাবনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাওমি বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী বলেন,
বৈশ্বিক মোবাইল হ্যান্ডসেট বাজারে প্রবেশ করতে হলে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক। এই খাতে বিনিয়োগ বাড়লে বাংলাদেশের হ্যান্ডসেট কারখানাগুলোর মান, শ্রমশক্তির দক্ষতা এবং সক্ষমতাও বাড়বে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও ফিচারসমৃদ্ধ মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন ও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
তিনি আরো জানান, মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন শিল্পটি প্রযুক্তি- নির্ভর হওয়ায় বাংলাদেশকে দক্ষ শ্রমশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। মোবাইল হ্যান্ডসেট রপ্তানিকারক শীর্ষ দেশগুলোয় অবকাঠামো ও জনশক্তিসহ রপ্তানির উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে সময় লেগেছে প্রায় এক দশক।বাংলাদেশ থেকে মোবাইল হ্যান্ডসেট রপ্তানির পক্ষে সবচেয়ে সহায়ক বিষয় হলো অব্যবহৃত উৎপাদন সক্ষমতা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য মতে, বাংলাদেশে স্থাপিত ১৭টি কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১২ কোটি ইউনিট। এর বিপরীতে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেটের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৫ কোটি ইউনিট যা মোট উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকেরও কম। আমাদের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে কোনো ধরনের নতুন বিনিয়োগ ছাড়াই এই পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বাৎসরিক আরো প্রায় ৭ কোটি ইউনিট মোবাইল হ্যান্ডসেট রপ্তানির।
বাংলাদেশ তুলনামূলক সাশ্রয়ী শ্রমশক্তির কারণে অন্যান্য মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। দেশে মাথাপিছু আয় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও শ্রমিকদের মজুরি এখনো মোবাইল হ্যান্ডসেট রপ্তানিতে প্রতিষ্ঠিত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। এর ফলে বাংলাদেশ তুলনামূলক কম খরচে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে। বাংলাদেশ জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) এবং এলডিসির মতো অন্যান্য বাণিজ্যচুক্তির অধীনে বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে শুল্কমুক্ত এবং বিশেষ প্রবেশাধিকারের সুযোগ পাচ্ছে। এই সুযোগ সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে উচ্চ শুল্কের বোঝা ছাড়াই আন্তর্জাতিক বাজারে হ্যান্ডসেট বিক্রি করতে পারবেন বাংলাদেশের হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারীরা।
বিশ্বব্যাপী মোবাইল হ্যান্ডসেটের চাহিদা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো দ্রুত ডিজিটাল রূপান্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং স্মার্টফোন রয়েছে এই রূপান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে। এই বাজারগুলোতে বাংলাদেশি উৎপাদনকারীদের জন্য মোবাইল হ্যান্ডসেটের রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। শাওমিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করায় শুধু বিনিয়োগ নয় দেশে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতাও নিয়ে এসেছে। এতে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির দক্ষতারও উন্নয়ন হয়েছে।
সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক
ON / MLY