ইন্টারনেটের নানান ব্যবহার জেনে মানসিকভাবে আত্মবিশ্বাসী শেরপুরের নারীরা।
‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের আওতায় সারা দেশের মতো শেরপুরেও চলছে উঠান বৈঠক। গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেটবিষয়ক জ্ঞান বাড়াতে শেরপুরের পাঁচটি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে উঠান বৈঠক, যা গত ২৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয় নালিতাবাড়ী উপজেলার মরিচপুরান ইউনিয়ন থেকে।
উঠান বৈঠকে কুইজ বিজয়ী নারীদের মধ্যে একজন শিবলী আক্তার। তিনি স্থানীয় আবদুর রশিদ ডিগ্রি মহিলা কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। শিবলীর বাড়ি মরিচপুরান ইউনিয়নের আয়নাতলী গ্রামে। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি একজন উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে চান।
পুরস্কার জেতার পর কথা হয় শিবলী আক্তারের সঙ্গে। তাঁর বাবা একজন প্রান্তিক কৃষক। পরিবারে মা, বাবা, দাদি এবং ছোট ভাই, এক ছোট বোনসহ ছয়জন রয়েছে। মা অসুস্থ হওয়ায় সংসারের দায়িত্ব পড়েছে তাঁর কাঁধে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে পরিবারের অন্য সদস্যদের একাই যত্ন নেন তিনি। তাই কলেজ শেষে বাড়ি ফিরে পরিচালনা করছেন পরিবারও। এত সব ব্যস্ততার মধেও লেখাপড়ায় বিরতি দেননি শিবলী। তাঁর স্বপ্ন লেখাপড়ার পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে একজন উদ্যোক্তা হওয়া। এ প্রসঙ্গে শিবলী আক্তার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার শখ ফ্যাশন ডিজাইনার হব। নারী ও শিশুদের জামাকাপড় তৈরির পাশাপাশি শাড়িতেও নকশার কাজ করার আগ্রহ আছে আমার।’ তিনি আরও বলেন, ‘উঠান বৈঠকে অংশ নিয়ে আমার স্বপ্নপূরণে এক ধাপ এগিয়ে গেলাম। অনেক অজানা বিষয় জেনে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।’
কীভাবে পেলেন উঠান বৈঠকের খোঁজ? জানতে চাইলে শিবলী বলেন, ‘বন্ধুসভার সুজন শীল ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম আমাদের গ্রামে একটি উঠান বৈঠক হবে। ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে নারীদের শেখানো হবে, জানা যাবে অনেক কিছু। তাই যথাসময়ে অংশ নিতে চলে আসি।’
শিবলী আক্তারের মতো অসংখ্য গ্রামীণ নারী অংশ নেন শেরপুরের মরিচপুরান ইউনিয়নের গোজাকুড়া গ্রামের বকুল রানীর বাড়ির উঠানে অনুষ্ঠিত বৈঠকে। তাঁদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে উঠান বৈঠক সঞ্চালনা করেন স্থানীয় বন্ধুসভার সদস্য নাদিয়া আক্তার। স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে উপস্থিতি নারীদের নানা ধরনের তথ্য ও ভিডিও দেখান তিনি।
বৈঠকে আসা জুলেখা বেগম নামের এক গৃহিণী উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, ‘কথা কওয়া ছাড়াও এই মোবাইলে ইন্টারনেট দিয়া ঘরে বইসাই শাড়ি, কাপড়ে নকশা করার কাজ শিখন যায়। এ অনুষ্ঠানে আইসা আমরা অনেক কিছু জানবার পাইলাম।’
এবার শেরপুর শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরের গ্রাম আয়নাতলীতে যাওয়া যাক। সবুজ গাছগাছালি, ছায়ায় ঘেরা নিরিবিলি পরিবেশ। গ্রামটি নালিতাবাড়ী উপজেলার রূপনারায়ণকুড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। এই গ্রামেরই নাছিমা খাতুনের বাড়ির উঠানে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আসা নারীদের একজন গৃহিণী সেফালী খাতুন। উপস্থিত নারীদের মধ্যে সবার আগে কুইজের সঠিক উত্তর দিয়ে তিনি জেতেন পুরস্কার। সেফালীর এই প্রাপ্তিতে তুমুল করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান অন্য নারীরা। বিজয়ী হওয়ায় উষ্ণ শুভেচ্ছা পেয়েছেন গৃহিণী আমেনা বেগমও। উঠান বৈঠকে স্বাস্থ্য বিষয়ে এক কুইজে সবার আগে সঠিক উত্তর দিয়ে পুরস্কার জেতেন আমেনা। তিনি বলেন, ‘আমরা মোবাইল ফোনে শুধু কথা কই আর গান শুনি। কিন্তু কেমনে করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া যায়, শিশুগর কেমনে যত্ন নেওয়া যায়—এইখানে আইসা আমগর মতো নারীরা এরম নতুন অনেক কিছুই জানতে পারলাম।’
‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানটি শিবলী আক্তার, সেফালী খাতুন ও আমেনা বেগমের মতো অসংখ্য গ্রামীণ নারীর জীবনে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা চলার পথের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারছেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে উঠান বৈঠক। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় গতকাল রোববার (১০ নভেম্বর) পর্যন্ত ১ হাজার ৬১১টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে। গ্রামীণফোনের উদ্যোগে এই আয়োজনের সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক।