ন্যানো প্রযুক্তির শিখরে ইরান
ন্যানো প্রযুক্তি, যা পদার্থের আণবিক ও পরমাণু স্তরে কাজ করে, আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম চমকপ্রদ ক্ষেত্র। মাত্র ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার মাপের কণা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি শিল্প, চিকিৎসা, পরিবেশ এবং শক্তি খাতে বিপ্লব আনছে। আসলে উচ্চ মাত্রার বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে ব্যবহার করে ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার আকৃতির মধ্যে কোন যন্ত্রাংশ, ডিভাইস বা কোনো সিস্টেম ডিজাইন ও তৈরি করা এবং ব্যবহার করাকে ন্যানোটেকনোলজি বলে। ন্যানোমিটার হলো মেট্রিক পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একটি একক। যা কিনা এক মিটারের একশ কোটি ভাগের এক ভাগের সমান হয়ে থাকে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে ন্যানো প্রযুক্তির প্রভাব সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের চিকিৎসায় এটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ন্যানো পার্টিকেলের সাহায্যে সরাসরি ক্যান্সার কোষে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব, যা পাশ্বরূপ কমিয়ে রোগ নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এছাড়া, ন্যানো বায়োসেন্সরের মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজ বা কোলেস্টেরলের পরিমাণ দ্রুত নির্ধারণ করা যায়।
শিল্প খাতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পণ্যের মান উন্নত ও উৎপাদন খরচ হ্রাস সম্ভব হয়েছে। ন্যানো-ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে হালকা, মজবুত এবং পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রী। এছাড়া, ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্মার্ট ফোন ও কম্পিউটারের পারফরম্যান্স বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায়ও ন্যানো প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। পানি শোধনে ন্যানো ফিল্টার ব্যবহারের ফলে দূষিত পানি বিশুদ্ধ করা সহজ হয়েছে। বাতাসের দূষণ কমাতে ন্যানো ক্যাটালিস্ট কার্যকর ভূমিকা রাখছে। শক্তি খাতে, বিশেষ করে সৌরশক্তি উৎপাদনে, ন্যানো প্রযুক্তি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। ন্যানো সোলার সেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমানো সম্ভব হয়েছে, যা টেকসই শক্তি উৎপাদনে সহায়ক।
বৈশ্বিক পর্যায়ে ন্যানোটেকনোলজি নিয়ে গবেষণারত ওয়েবসাইট স্ট্যাটন্যানো এর দেয়া তথ্যমতে, ন্যানো টেকনোলজি শিল্প উন্নয়নে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের শীর্ষ চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে ইরানের নাম। দেশটির বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা এবং ন্যানো প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের সফলতা পেয়েছে।
বর্তমানে বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রতিনিয়ত ন্যানো টেকনোলজির পণ্য উৎপাদন, গবেষণা এবং রপ্তানি বাণিজ্য অবিশ্বাস্য গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একাধিক গবেষণামূলক থিংক ট্যাংকের দেওয়া তথ্যমতে, গত ২০২৩ সালে বৈশ্বিক ন্যানো টেকনোলোজির বাজার মূল্য ছিল আনুমানিক ৭৯.১৪ বিলিয়ন ডলার। যা প্রতি বছর খুবই দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাছাড়া ন্যানো টেকনোলজির বাজার মূল্য কিনা চলতি ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত প্রায় ৯১.১৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যেতে পারে। তাছাড়া এই সেক্টরের আকার আগামী ২০৩২ সালের দিকে খুব সম্ভবত ৩৩২.৭৩ বিলিয়ন ডলারের সীমাকে অতিক্রম করতে পারে। এদিকে চলতি ২০২৪ সালের হিসেব অনুযায়ী উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীনের ন্যানো কেমিক্যাল মার্কেট সাইজ হচ্ছে ৩.২ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে ন্যানো টেকনোলজিতে রাজত্ব করা বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় এবং প্রভাবশালী দেশগুলো হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, ইরান চীন এবং ভারত। যদিও এই সেক্টরের প্রায় ৪৬% একাই দখল করে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া গত ২০২৩ সালে উত্তর আমেরিকার ন্যানো টেকনোলজির বাজারের আকার ছিল প্রায় ২৫.৭১ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে শত প্রতিবন্ধকতা মধ্যেও অনেকটা সীমিত পরিসরে ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণায় এগিয়ে যাচ্ছে ইরান। দেশটির নিজস্ব ন্যানো প্রযুক্তির পণ্য বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। দেশটির এই রপ্তানির তালিকায় রাশিয়া, ভারত, চীনের পাশাপাশি তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক এবং আজারবাইজানের মতো দেশের নাম স্থান পেয়েছে।
ইরানের ন্যানো ও মাইক্রো টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট দফতরের দেয়া তথ্যমতে, গত ২০২৩ সালে ইরানের ন্যানো টেকনোলজির পণ্য বিক্রির মোট পরিমাণ ছিল ১.৬২ বিলিয়ন ডলার। যার প্রায় ৯১% নিজ দেশেই বিক্রি বা ব্যবহার করা হয়েছে। আর অবশিষ্ট ৯% অর্থাৎ ১৪৫ মিলিয়ন ডলারের ন্যানো প্রযুক্তির পণ্য সারা বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে।
গত ২০২৩ সালে এই সেক্টরে তার আগের ২০২২ সাল অপেক্ষা প্রায় ১১০% অধিক রপ্তানি ন্যানো প্রযুক্তির পণ্য রপ্তানি করে ইরান। আর এবার চলতি ২০২৪ সাল শেষে ইরানের ন্যানো প্রযুক্তির বাজারের আকার হতে পারে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের অধিক। তাছাড়া ইরানি বিজ্ঞানীরা ন্যানোপ্রযুক্তি সংক্রান্ত নিবন্ধ, রিসার্চ পেপার প্রকাশ এবং ন্যানো পণ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ সাত দেশের তালিকায় নিজের যোগ্য স্থান করে নিয়েছে ইরান।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, পার্স টুডে, স্ট্যাটন্যানো, ফরচুন বিজনেস ইনসাইড।
সিরাজুর রহমান, (Sherazur Rahman), শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।