কিছু দেশ কেন আইসিসির সদস্য না
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালত – আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। যুদ্ধপতি বা সরকার-প্রধান, যেই হোন না কেন— এই আদালত তাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সমন জারির ক্ষমতা রাখেন। তবে এই আদালতের কর্তৃত্বকে স্বীকার করে না যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের কিছু ক্ষমতাধর দেশ, এবং তারা আদালতের আওতাধীন বা সদস্য দেশ হতেও নারাজ।
আন্তর্জাতিক যে চুক্তির মাধ্যমে এই আদালত গঠিত হয়– এতে তারা হয় সই করেনি, নাহলে পরে নিজদের প্রত্যাহার করেছে।
১৯৯৮ সালে রোম স্ট্যাটিউট নামক চুক্তির অধীনে আইসিসি গঠন করা হয়। এই আদালতকে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা অর্পণ করে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো। ১২০টি দেশ বর্তমানে আইসিসির সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে অনেক ইউরোপীয় দেশ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংঘাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহে সক্রিয়ভাবে জড়িত। যেসব সংঘাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও অসংখ্য। তাই আইসিসি যেন আমেরিকান রাজনৈতিক বা সামরিক নেতৃত্বকে বিচারের সম্মুখীন না করতে পারে– এজন্যই রোম চুক্তিতে সই করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
চীন, ভারত, রাশিয়া, ইসরায়েলও আইসিসির সদস্য হয়নি।
সম্প্রতি গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গালান্ত এবং হামাসের সামরিক প্রধান মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা কোনো ব্যক্তিকে আটক করে আইসিসির কাছে সোপর্দ করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে এর সদস্য দেশগুলোর।
আইসিসির এই ক্ষমতা নিয়ে মার্কিনীদের ঘোর আপত্তি আছে। বিশেষত অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি সদস্য দেশের নাগরিক না হয়, তাহলে তাকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেও – আইসিসির এ ধরনের কর্তৃত্ব ফলানো উচিৎ নয় বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সময়ের প্রশাসনগুলো। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার না করতেও একই দাবি পুনর্ব্যক্ত করছেন মার্কিন আইনপ্রণেতা ও কূটনীতিকরা।
রোম স্ট্যাটিউট এর অন্যতম আলোচক এবং সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিভ স্ক্যাফের বলেন, ‘উভয় দেশের (যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের) আঞ্চলিক বা বৈশ্বিকভাবে যেরকম সামরিক কর্মকাণ্ড রয়েছে, তার ফলে নিষ্ঠুর অপরাধের অভিযোগে আদালতের দ্বারা তদন্তের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে; এছাড়া প্রমাণ-ভিত্তিক বিচারের চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ভয়ও আছে।’
স্ক্যাফের বলেন, এসব আশঙ্কাকে খণ্ডন করার মতো শক্ত পাল্টা যুক্তি আছে। যেমন বলা হয়, ইচ্ছেকৃতভাবে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারী কোনো দেশের নেতারই বিচারের আওতামুক্ত থাকা মেনে নেওয়া যায় না।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রে এই যুক্তিকে মেনে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের তাগিদে, চলতি বছরের ২১ আগস্ট আইসিসির সদস্য হতে রোম চুক্তিতে সইয়ের পক্ষে ভোট দেয় ইউক্রেনের পার্লামেন্ট রাদা। এরপরে দেশটি ১২৫তম সদস্য হিসেবে আইসিসির অন্তর্ভুক্ত হয়। ইউক্রেনে যেন রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের বিচার করা সম্ভব হয়– এজন্যই ওয়াশিংটন এতে সমর্থন দিয়েছিল। তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ রোম চুক্তির স্বাক্ষরকারী হলেও– ইসরায়েলের ক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন দেখতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণেই বৃহস্পতিবার আইসিসি গেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার ঘটনায়– তাৎক্ষনিকভাবে এর নিন্দা জানায় বাইডেন প্রশাসন।
বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, “জ্যেষ্ঠ ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদালতের এই সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে আদালতের কৌঁসুলিদের ব্যতিব্যস্ত আচরণে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
রিপাবলিকান দলের প্রভাবশালী সিনেটররাও এর নিন্দা জানান। যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাইকেল ওয়ালৎজ, নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যাকে তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত করেছেন। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ওয়ালৎজ বলেন, গাজা যুদ্ধে ‘বৈধভাবে’ সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে ইসরায়েল; এজন্য আদালতের নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্প ক্ষমতাগ্রহণের পরে তাঁর প্রশাসন আইসিসির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিবে – এই বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। ওয়ালৎজ বলেন, “জানুয়ারি মাস আসতে দিন, আইসিসি ও জাতিসংঘের ইহুদি-বিদ্বেষী আচরণের বিরুদ্ধে (যুক্তরাষ্ট্রের) শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখতে পাবেন।”
সুত্র: tbs
ON/RMN