কিম জং তাকে মিস করছেন, দাবি ট্রাম্পের!
যুক্তরাষ্ট্র ও উ. কোরিয়া একে-অন্যের ‘ঘোষিত শত্রু’। কূটনৈতিক আদান-প্রদান তাই বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়, বিশেষত শীর্ষ পর্যায়ের। ব্যতিক্রম ছিল কেবল ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ। কোরীয় যুদ্ধাবসনের পর আমেরিকার আর কোনো রাষ্ট্রপতির মেয়াদেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এত নাটকীয়তা দেখেছি।
ট্রাম্প আমলে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে উ. কোরিয়া, যা বন্ধ না করলে ‘কঠিন শাস্তি’ পেতে হবে এমন হুমকি দেন ট্রাম্প। কিম জন উনের সাথে তাঁর উত্তেজনা থেকে এক পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কাও তৈরি হয়। তবে শেষপর্যন্ত ট্রাম্প শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেন এবং কিম জন উনের সাথে প্রকাশ্যে গড়েন সখ্যতা। দুই নেতার মধ্যে ধারাবাহিকভাবে বৈঠকে মিলিত হন। সেসময় ট্রাম্প দাবিও করেন যে, তাঁদের মধ্যে ‘সৌহার্দ্য’ হয়েছে। যদিও দ্বিপাক্ষিক এসব সম্মেলনে পর্যব্যসিত হয়েছিল ব্যর্থতায়।
নির্বাচনে জিতে আগামী জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ফিরছেন ট্রাম্প। এবারে ‘অদ্ভুত’ সেই বন্ধুত্ব পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। কারণ, কিমের শাসকগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর মিত্রদের নতুন পদক্ষেপের মাধ্যমে শঙ্কিত করে তুলেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ায় হাজার হাজার সেনা ও লাখো টন গোলাবারুদ পাঠিয়েছে পিয়ংইয়ং। গোলাবারুদ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার হয়েছে, আর উ. কোরীয় সেনারা কুর্স্কে যুদ্ধে নামবে বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কিছুদিন আগ থেকেই অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ঘটেছে এসব ঘটনা। এমনকী নির্বাচনের দিনকয়েক আগেই ৩১ অক্টোবর একটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, যা কিনা পরমাণু অস্ত্রবহনের সক্ষম এবং যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে পারবে।
নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে ট্রাম্প দাবি করেন, কিম তাঁকে ‘মিস’ করেছেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরে দেশটি আর এধরনের আগ্রাসী আচরণ করবে না বলেও ইঙ্গিত দেন। কিন্তু ট্রাম্প যাই বলুন, এবার তাঁর প্রশাসনকে আরও দুঃসাহসী ও বিপজ্জনক হয়ে ওঠা উ. কোরিয়ার এই নেতাকে মোকাবিলা করতে হবে। এমনটা বলা হয়েছে সিএনএনের বিশ্লেষণে।
মস্কোকে সাহায্য করার বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি পাচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে কিমের হাতে থাকা অপ্রচলিত অস্ত্রের ভাণ্ডার হয়েছে আরও সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। ফলে যুক্তরাজ্য ও তাঁর মিত্র দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে পিয়ংইয়ংয়ের রণ-প্রস্তুতি আগের চেয়ে মজবুত হয়েছে– তাও বলাই যায়। ট্রাম্প আমলের ব্যর্থ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরে – বাইডেন প্রশাসন আর সেপথে হাঁটেনি। সেই অবসরে কাছাকাছি এসেছে মস্কো-পিয়ংইয়ং। ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়াকে উত্তর কোরিয়ামুখী যেমন করে; তেমনি বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ওঠা, অর্থনৈতিক সুবিধা, সামরিক প্রযুক্তিলাভ ইত্যাদি বিবেচনায় কিম জন উন-ও পুতিনের ডাকে সাড়া দেন।
ফলে এবার উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করা নিয়ে যেকোনো চুক্তিতে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজের ‘অস্থির’ পররাষ্ট্রনীতির জন্য পরিচিত ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে এবার এই লক্ষ্যগুলো পরিবর্তন করতে চাইতে পারেন।
‘ঘনিষ্ঠ কমরেড’
২০১৮-১৯ সময়ে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামের হ্যানয় ও দুই কোরিয়ার মধ্যে সীমান্তের বিশেষ অঞ্চলে ট্রাম্প ও কিমের মধ্যে বেশকিছু বৈঠক হয়।
বৈঠকের ছবিগুলোতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক পরাশক্তির নেতাকে হাসিমুখে দেখা গেছে, রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন এক নির্মম স্বৈরশাসকের পাশে। যিনি নিজ নিজের শাসকগোষ্ঠীকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে এমন অস্ত্রের উৎপাদন করছেন।
ট্রাম্প দাবি করেন, আগের মার্কিন প্রেসিডেন্টরা উ. কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী নীতি নিয়ে যা অর্জন করতে পারেননি, এসব বৈঠকের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, এর বিকল্প উপায় রয়েছে। অর্থাৎ আলোচনার মাধ্যমেও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতে পারে। এটিকেই তিনি নিজের অর্জন বলে কৃতিত্ব দেন। অন্যদিকে, ট্রাম্পের সাথে বৈঠকের সুবাদে আন্তর্জাতিক স্তরে দীর্ঘদিন পরে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসার সুযোগ পান কিম। একইসঙ্গে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ উঠে যেতে পারে এমন সম্ভাবনাও তাঁকে বৈঠকে প্রলুদ্ধ করে।
তবে কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই ২০১৯ সালের হ্যানয় সম্মেলনে দুই নেতার মধ্যে আলোচনা ভেস্তে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এতে দেশের অভ্যন্তরেও ব্যাপক মানহানি হয় কিম জন উনের।
পরে ওই বছরেই দুই নেতার মধ্যে আরও একবার বৈঠক হয়, তবে এবার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পুনরায় আলোচনায় বসতে সম্মত হয়নি পিয়ংইয়ং। এরপরে আবারো ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা কর্মসূচি শুরু করে। ২০১৭ সালের পরে আর পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়নি উত্তর কোরিয়া, তবে কিম জং উন তাঁর দেশের পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জাও ব্যাপকভাবে বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছে সম্প্রতি।
ওয়াশিংটনের স্টিমসন থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সিনিয়র ফেলো র্যাচেল মিনইয়ুং লী বলেন, পাঁচ বছর আগের তুলনায় বর্তমান উত্তর কোরিয়ার পরিস্থিতি অনেক ভিন্ন। যেকোনো কূটনতিক উদ্যোগকে এই বাস্তবতার মুখে পড়তে হবে।
তিনি বলেন, হ্যানয় সম্মেলনের পর থেকে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বহুদূর অগ্রগতি হয়েছে, যেকারণে এসব পরিত্যাগ করার আলোচনায় পিয়ংইয়ং এবার ‘অনেক চড়া মূল্য’ চাইবে। কারণ, হ্যানয় সম্মেলনের পরে নিজ শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেও নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন কিম, একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যেকোনো বৈরিতা অবসানের আদৌ কোনো কৌশলগত গুরুত্ব আছে কিনা– সে প্রশ্নও উঠেছে।
গত এক বছরে উ. কোরিয়ার নীতিতে বড় পরিবর্তন এনেছেন কিম, এসময়ে তিনি বহু দশকের ঐতিহ্য ভেঙে দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘স্থায়ী শত্রু’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী সামরিক কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় নিজ সেনাবাহিনীর প্রতি যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশও দেন। বাইডেন প্রশাসন যখন দ. কোরিয়া ও জাপানের সাথে সামরিক তৎপরতা তথা মহড়া জোরালো করে– তারমধ্যে কিমও নেন কঠোর এই অবস্থান।
আর রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক গভীর হতে শুরু করার পর থেকেই – উত্তর কোরিয়ার এই নেতা তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ কমরেড’ ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে গত সেপ্টেম্বরের পর দুইবার বৈঠক করেছেন। তার আগে জুনে দুই দেশের মধ্যে সামরিক জোটবন্ধনের এক চুক্তিও হয় — যেখানে তারা এক দেশ আক্রান্ত হলে অন্যটি এগিয়ে আসবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমা কর্মকর্তারা হুঁশিয়ার করে বলছেন, চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান ও রাশিয়া মিলে এক পশ্চিমাবিরোধী অক্ষ তৈরি হচ্ছে; বিশ্ব রাজনীতির এমন মোড় পরিবর্তনকে সুনজরেই দেখছেন কিম এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনের বিষয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়েছেন।
লী বলেন, ‘কিমের দৃষ্টিতে – যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পুনরায় সমঝোতার পথে না হেঁটে, বরং চীন ও রাশিয়ার সাথে মিত্রতা গভীর করে অনেক বেশি অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে কী লাভ হবে– সেটি নিশ্চিত নয়।’
গত সেপ্টেম্বরে সিওলে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড নলেজ ফোরামে অংশগ্রহণকালে ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও’ব্রায়ান বলেন, প্রেসিডেন্ট হলে উত্তর কোরিয়ার সাথে পুনরায় আলোচনা শুরু করবেন ট্রাম্প। ট্রাম্প সত্যিই আবারো উদ্যোগী হবেন কিনা– সেটি দেখার বিষয়। কারণ, এবার ট্রাম্পের সাথে কিম আলোচনায় বসতে নাও চাইতে পারেন।
উ. কোরিয়ার নেতা তাঁর অভাব অনুভব করছেন ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম স্পষ্ট করেই বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে কে প্রেসিডেন্ট হলেন না হলেন– ‘তারা সেটির ‘পরোয়া করে না।’
অর্থাৎ, এবিষয়ে পিয়ংইয়ংয়ের আনুষ্ঠানিক অবস্থান হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিবর্তনই ঘটুক– তারা পারমাণবিক অস্ত্রের নীতি বদলাবে না।
অবশ্য পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ স্বীকৃতিলাভ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল থেকে মুক্তি – এ দুইই কিম জং এখনও চান বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। ফলে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনকে তিনি লাভজনক সম্ভাবনা হিসেবে দেখতে পারেন।
সিওলের কিংগনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ কোরিয়া রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ইয়ুল-চুল লিম বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে অবিশ্বস্ত মনে করেলও ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনঃনির্বাচিত হওয়া নিয়ে কিম জং উন আশাবাদী হতে পারেন। ট্রাম্পের সাথে ব্যক্তিগত ‘বন্ধুত্বকে’ আবারো সামনে এনে তাঁর সাথে যোগাযোগের চেষ্টাও হয়তো করবেন।’
‘রাশিয়ারা সাথে উত্তর কোরিয়ার জোট শক্তিশালী হওয়ায়– এটিও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যেকোনো আলোচনায় তাঁকে দর কষাকষির ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে রাখবে’ – বলেন তিনি।
অবশ্য ট্রাম্প এ ধরনের কোনো চুক্তি করতে আগ্রহী হবেন কিনা, এবং হলেও তা কোন ধরনের চুক্তি হবে – সেটিও আরেক প্রশ্ন।
কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, উ. কোরিয়ার সাথে প্রত্যাশিত চুক্তিটি করতে যুক্তরাষ্ট্রের দাবিদাওয়া শিথিল করতে পারেন ট্রাম্প, নাহলে সামরিক উত্তেজনার পারদ চড়িয়েও পাল্টা চাপ দিতে পারেন।
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সিনিয়র ফেলো দাইয়ু কিম বলেন, ‘ট্রাম্প অনুমানযোগ্য নন… ফলে তাঁর প্রথম মেয়াদকে সূচক হিসেবে ধরে নিয়ে এবারের আচরণের অনুমান করা ঠিক হচ্ছে না। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে পুঁজি করে ট্রাম্প এখনও তা বন্ধের জন্য সচেষ্ট হন কিনা–আমাদের তা দেখতে হবে। তবে সবচেয়ে খারাপ হবে যদি তিনি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণকে বাদ দেন।
ON/RMN