হারিয়ে যাচ্ছে ‘তিস্তার রূপালি ইলিশ’ বৈরালি মাছ

বৈরালি মাছকে এ অঞ্চলের ‘রূপালি ইলিশ’ বলা হয়ে থাকে। বৃহত্তর রংপুর বিভাগের মানুষের কাছে এটি অত্যন্ত প্রিয় একটি মাছ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় নদ-নদীর মধ্যে তিস্তা নদীতেই সুস্বাদু এই মাছ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তিস্তার বুকে আশানুরূপ বৈরালি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন স্থানীয় মৎস্যজীবীরা।
বৈরালি, বরালি বা বরালিয়াস (Barilius) নামটি মূলত একটি মাছের প্রজাতি বোঝায়। Barilius প্রজাতির অধীনে পাঁচটি প্রধান ধরনের মাছ পাওয়া যায়। এগুলো হলো বরালি, ভাগরা বরালি, হিরালু বরালি, বাজইয়া, ডোগার সিং বরালি এবং তিলা। তবে, বৈরালি মাছ ছাড়া এ গোত্রের অন্যান্য মাছ বাংলাদেশে প্রায় দেখা যায় না। ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, এই মাছটি ‘বোরালি’ নামে পরিচিত।
বৈরালি মূলত স্বচ্ছ ও প্রবাহমান পানির মাছ। পাহাড়ি উত্স থেকে নেমে আসা তিস্তা ও ধরলা নদীতে এ মাছের প্রাচুর্য দেখা যায়। এই মাছের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ৬-৭ ইঞ্চি বা ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। রূপালি বর্ণের মাছটির গায়ে ছোট ছোট আঁশ থাকে। পিঠের রং হালকা মেটে আর পেটের নিচে থাকে হলুদ রঙের দাগ। মাছটির কাঁটা থাকলেও তা নরম এবং সহজে চিবানো যায়।
বৈরালি মাছের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ইলিশের মতো হওয়ায় এটি “তিস্তার ইলিশ” নামেও পরিচিত। তীব্র স্রোতে ভাটির পাশাপাশি উজানের দিকে ছুটে চলার প্রবণতা এবং ঝাঁকে ঝাঁকে চলার অভ্যাস এ নামের অন্যতম কারণ। মাছটি দ্রুত গতির হওয়ায় এটি ধরাও বেশ কঠিন।
বৈরালি মাছ দিনের বেলায় সাধারণত গভীর পানিতে অবস্থান করে। তবে বিকাল থেকে রাতের দিকে নদীর কিনার ঘেঁষে পানির উপরের স্তরে এসে ঝাঁকে ঝাঁকে চলতে দেখা যায়। স্থানীয় জেলেরা ছোট চটকা জাল (হাতে টানা জাল) দিয়ে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাছটি আহরণ করেন।
গবেষণায় জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এবং পৌষ-মাঘ মাসে জেলেদের চায়না জাল দিয়ে পোনা শিকারের কারণে বৈরালির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা নদীর পানি সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং অপরিকল্পিত মাছ শিকারও এ সংকটের অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশে ২৮৯ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে তিস্তা নদীতে পাওয়া যেত ৪২ প্রজাতির মাছ। তবে বর্তমানে মাছবৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। “বাংলাদেশের তিস্তার মাছবৈচিত্র ও তিস্তা নদীর জেলে জীবন” শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
আগে প্রতি কেজি বৈরালি ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি হলেও, বর্তমানে তা ৬০০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য মাছটি ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মৎস্যজীবীরা পোনা ধরার মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি লাভ করলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি তাদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বৈরালি মাছের সংকট মোকাবেলায় তিস্তা নদীতে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা, পোনা শিকার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং সুষ্ঠু প্রজনন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় সচেতনতার মাধ্যমেও বৈরালির প্রাপ্যতা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
সুস্বাদু স্বাদ ও তিস্তার ঐতিহ্যবাহী মাছবৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে বৈরালি মাছ সংরক্ষণে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তিস্তার বুকে ফের রূপালি ঝিলিক দেখতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
-সাব্বির হোসেন, হাতীবান্ধা
ON/MDK