‘ভারতের বুকে’ এক টুকরো বাংলাদেশ; তিন বিঘা করিডোর।
তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলা সীমান্ত এবং ভারতের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ ব্লক সীমান্তে ভারত ভূখন্ডে অবস্থিত একটি স্বতন্ত্র এলাকা৷ এই তিনবিঘা এলাকার অবস্থানটি এমন যে এই স্থানটি ভারতের ভূখন্ড হলেও এটি বাংলাদেশের লালমনিহাট জেলার দহগ্রাম ও আঙুরপোতা গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। যার ফলে এই দুটি ছিটমহলের কয়েক হাজার মানুষের বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের সাথে সরাসরি যোগাযোগ একদমই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, কারণ মাঝে ছিল ভারতের কোচবিহার মেখলিগঞ্জের তিনবিঘা এলাকা। ১৯৮২ সালে দুই দেশের এক চুক্তির ফলে এই তিন বিঘা এলাকা জুড়ে একটা করিডোর নির্মাণ করা হয় যার ফলে বাংলাদেশের দহগ্রাম ও আঙুরপোতা এলাকার কয়েক হাজার মানুষ খুবই সহজে এই করিডোর ব্যবহার করে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডে যাওয়া আসা করতে পারছে। আর এটাই তিনবিঘা করিডোর নামে পরিচিত।
তিন বিঘা করিডোরটি পুরোটাই ভারতের ভূখন্ডে অবস্থিত হলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (লীজ) মাধ্যমে বাংলাদেশ তিন বিঘা করিডোর এর মালিক। যার এক দিকে আছে ভারতের কুচলিবাড়ি, অপরদিকে আছে মেখলিগঞ্জ। এই দুটি জায়গা যাওয়ার রাস্তা এই তিন বিঘা করিডোর হয়েই গিয়েছে, এখানে আসলে দুদেশের রাস্তা একইসাথে দেখতে পাবেন। বাংলাদেশের মানুষেরাও এই করিডোর হয়ে যাতায়াত করছে সেটাও দেখতে পাবেন আবার ভারতের নাগরিকরাও এই করিডোর ব্যবহার করছে দেখতে পাবেন। আগে করিডোর মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য খোলা থাকতো, এখন নতুন চুক্তির ফলে ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে, যার ফলে অনেক সুবিধাই হয়েছে।
নামকরণ
তিন বিঘা নামের উৎপত্তিও বাংলা থেকেই। বাংলা আয়তন পরিমাপের একটি একক বিঘা থেকে তিন বিঘা নামের উৎপত্তি, ভূমিটির মোট আয়তন ১ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৭৭১ বর্গমিটার (১৬ হাজার ১৫০ থেকে ৭২ হাজার ৮৮০ বর্গফুট) যা তিন বিঘা পরিমাপের সমান। তিস্তা পাড়ের এই গ্রামের চারপাশেই হলো ভারতীয় ভুখন্ড এবং বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে এই ছিটমহল প্রায় ২০০ মিটার দূরে। আর এই ১৭৮ মি. দৈর্ঘ্য আর ৮৫ মি. প্রস্থের তিন বিঘা করিডোরই হচ্ছে দহগ্রামে যাবার একমাত্র পথ৷
ইতিহাস
১৯৭৪ সালের ১৬ মে ইন্দিরা গান্ধী-শেখ মুজিবুর রহমান চুক্তি অনুসারে ভারত ও বাংলাদেশ তিন বিঘা করিডোর দক্ষিণ বেরুবাড়ীর সার্বভৌমত্ব পরস্পরের কাছে হস্তান্তর করে৷ যার আয়তন ১৭৮ বাই ৮৫ মিটার বা ৫৮৪ ফুট × ২৭৯ ফুট ও ৭.৩৯ বর্গ কিলোমিটার বা ২.৮৫ বর্গমাইল। এরফলে উভয়দেশেই তাদের ছিটমহলে যথাক্রমে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ও দক্ষিণ বেরুবাড়ীর যাতায়াত সুবিধা তৈরি হয়৷ এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ সরকার সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষিণ বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তর করে যদিও ভারত তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশের কাছে রাজনৈতিক কারণে হস্তান্তর করেনি। কারণ এটি হস্তান্তরে ভারতের সাংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের অনেক বিরোধিতার পর ২০১১ সালে ভারত পূর্ণভাবে এটি বাংলাদেশকে দেয়ার বদলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ইজারা হিসাবে দেয়৷ শর্ত ছিল যে, একই সময়ে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। ১২ নং দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়নের মোট আয়তন ২২.৫৮ বর্গকিলোমিটার (৮.৭২ বর্গমাইল)। যার ১১.২৯ বর্গকিলোমিটার বা ৪.৩৬ বর্গমাইল পায় বাংলাদেশ। এছাড়াও পূর্বের ভাগ অনুসারে কোচবিহারের চারটি ছিটমহল বাংলাদেশে পড়ে। যার আয়তন ৬.৮৪ বর্গকিলোমিটার বা ২.৬৪ বর্গমাইল। এভাবে মোট আয়তন দাঁড়ায় ১৮.১৩ বর্গকিলোমিটার (৭.০০ বর্গমাইল)। যা বাংলাদেশে স্থানান্তর হওয়ার কথা ছিল।
১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী এই ভূখন্ডগুলোর মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ভারতে হস্তান্তরের কথা ছিল। যার মোট আয়তন ১৮.৬৮ বর্গকিলোমিটার (৭.২১ বর্গমাইল) ও ১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ছিল মুসলমান। যদি এই হস্তান্তর সফল হতো তাহলে এটি জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকত৷ ফলে তখন বেরুবাড়ীর জনগণ এই হস্তান্তরের বিরোধিতা করে বসে৷
এরপর ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয় বেরুবাড়ীর অর্ধাংশ ভারতের অধীন থাকবে এবং দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাংলাদেশেই থাকবে৷ এই চুক্তি অনুসারে ভারত দহগ্রাম- আঙ্গরপোতাবাসীর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটি তিন বিঘা আয়তনের জায়গা ইজারা হিসেবে দেয়। এটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল এবং তিন বিঘার চারপাশে সতর্কতার সঙ্গে বেষ্টনীও দেয়া হয়৷ যা ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিবর চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ১.১৪ ধারা অনুসারে বেরুবাড়ী বিরোধের অবসান ঘটে।
চুক্তি অনুসারে, “ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণাংশের অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করবে যার আনুমানিক আয়তন ৬.৮ বর্গকিলোমিটার (২.৬৪ বর্গমাইল) এবং এর বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম- আঙ্গরপোতা নিয়ন্ত্রণ করবে। ভারত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাসীদের বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৭৮ বাই ৮৫ মিটার (৫৮৪ ফু × ২৭৯ ফু) আয়তনের একটি ভূমি বাংলাদেশকে ইজারা হিসেবে দেবে৷
পূর্বে করিডোরটি দিনের ১২ ঘন্টা সময়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হত, এতে দহগ্রাম- আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হত কারণ সেসময় সেখানে কোন হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। সর্বশেষ গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ খ্রি. তারিখে ঢাকাতে অনুষ্ঠিত হাসিনা-মনমোহন বৈঠকে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশীদের যাতায়াতের জন্য তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা হচ্ছে। দিনে দিনে এই তিন বিঘা করিডোর রুপান্তরিত হচ্ছে এক পর্যটন কেন্দ্ৰে ৷
২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে করিডোরটি উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০১১ সালের পূর্বে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাতে কোনো হাসপাতাল বা কলেজ ছিল না। ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দহগ্রামে একটি দশ শয্যার হাসপাতাল ও দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের উদ্বোধন করেন৷ দহগ্রাম- আংগরপোতা গ্রামটি বেশি বড় নয়। তিস্তার ওপারেই ভারতীয় ভূখন্ড দেখতে পাবেন। দুই দেশের মানুষই এখানে একই নদী ব্যবহার করছে শান্তিপুর্ণভাবে৷
একনজরে তিন বিঘা করিডোর
৩ বিঘা করিডোরের আয়তন: ১৭৮*৮৫ মিটার।
বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে অবস্থিত।
তিন বিঘা করিডরের বিনিময়ে ভারত নেয়: বাংলাদেশের বেরুবাড়ী ছিটমহল (পঞ্চগড়)।
দহগ্রাম ও আঙ্গারপোতা ছিটমহল: লালমনিরহাট জেলাধীন পাটগ্রাম উপজেলার ছিটমহল।
ছিটের সংখ্যায় বাংলাদেশ পায়: ১১১টি আর ভারত লাভ করে ৫১টি।
তিন বিঘা করিডোর যাওয়ার উপায়
ঢাকা/রংপুর/লালমনিরহাট জেলা সদর থেকে সরাসরি বাস যোগে পাটগ্রামে যাওয়া যায়৷ এছাড়া ও রংপুর/লালমনিরহাট থেকে প্রতিদিন ০৫ টি ট্রেনে পাটগ্রামে যাওয়া যায়৷ পাটগ্রাম সদর থেকে দহগ্রাম তিনবিঘা করিডোরের দুরত্ব ০৯ কিলোমিটার। পাটগ্রাম থেকে সবসময়ে রিক্সা/টেম্পু যোগে তিনবিঘা করিডোরে যাওয়া যায়৷ এছাড়া ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে শুক্রবার ছাড়া বাকি ৬ দিন রাত ০৯ টা ৪৫ মিনিটে লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেন যাত্রা করে। লালমনিরহাট পৌঁছে ট্রেন বা বাসে পাটগ্রাম পৌছাতে হবে। পাটগ্রাম পৌঁছে রিকশায় কিংবা টেম্পুযোগে তিনবিঘা করিডোরে যাওয়া যায়। গাবতলী এবং কল্যাণপুর থেকে হানিফ ও শাহ আলী পরিবহনের বাস লালমনিরহাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়৷
-সাব্বির হোসাইন, হাতিবান্ধা
ON/RBL