রংপুরের এক বিদ্যালয়েই পড়ছে ২০ যমজ শিশু
চোখ, কান, মুখ ও হাসিসহ চলন-বলনে দেখতে প্রায় একই রকম। পড়াশোনাও করে একই বিদ্যালয়ে। রংপুরের বদরগঞ্জ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমনই ২০ জন যজম শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
চেহারায় মিল থাকায় ওদের চিনতে অনেক সময় বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সহপাঠীদের। শিক্ষকরাও প্রায়ই বিপাকে পড়েন। তবে যমজ ওই শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের আগ্রহ–উচ্ছ্বাসের কমতি নেই।
সম্প্রতি এই ২০ যজম শিশুর একই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা খবর জেনে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিক উজ জামান ওই শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। তিনি যমজ শিশুদের বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে ফুলের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি সবার খোঁজখবর নেন। সেই সঙ্গে অভিভাবকদের ডেকে বিভিন্ন সুপরামর্শ দেন। এই শিশুদের প্রতি দৃষ্টি রাখতে শিক্ষকদের পরামর্শ দেন তিনি।
কথা হয় ওই বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও মিতা সিনেমা হল রোডের দিলদার আলী ও রেশমা দম্পতির সঙ্গে। রেশমা আক্তার বলেন, এর আগেও তার ২ জন যমজ শিশু পড়াশোনা করেছে। ওরা এখন চেতনা বিদ্যানিকেতনে পড়াশোনা করছে। বর্তমানে আমার আরো যমজ দুই শিশু রুকু ও রিভা বদরগঞ্জ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। এ কারণে আমাকে নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসতে হয়। যজম শিশুদের মধ্যে মেলবন্ধন ও চলাফেরা দেখে ভালো লাগে। বিশেষ করে ২০ যমজ শিশু দেখে নিজেকে আমার ধন্য মনে হয়। ওরা সবাই যেন আমার নিজের সন্তানের মতোই।
শিশু শ্রেণির যমজ দুই শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমানের মা মোস্তফাপুর গ্রামের বৃষ্টি আক্তার বলেন, বাচ্চাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করছি। তাদের চাওয়া-পাওয়া সব একই রকম। একজন বিদ্যালয়ে না আসলে আরেকজন আসতে চায় না। একজন তাড়াতাড়ি যেতে চাইলে আরেকজন আর অপেক্ষা করতে চায় না। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয় না। আমরা সবকিছু মেনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বরং খুব লাগে যখন ২০ যমজ শিশুদের সবাই একসঙ্গে হয়। ওদের নিয়ে তো সবার মধ্যে বাড়তি আনন্দ, অনুভূতি ও ভালোবাসা কাজ করে।
আরেক যমজ শিশু ঐশী ও ইমনের বাবা দুর্জয় রায় জানান, নিয়মিত বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া আসা করতে হয়। সেক্ষেত্রে আমি অথবা আমার স্ত্রী দুজনেই বিদ্যালয়ে যাই। কোনো ধরনের সমস্যা মনে হয়নি। বরং এখানকার শিক্ষকরা একাধিক যমজ শিশুদের শিক্ষা দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা সব শিশুদের একই চোখে দেখেন, এটিই ভালো লাগা।
যমজ সন্তান লালন–পালনের বিষয়ে রাশিদা বেগম নামে এক অভিভাবক বলেন, যমজ সন্তান লালন–পালন করা কষ্টের। ওদের চাহিদা, রুচিবোধ আলাদা। ছেলে খেতে ভালোবাসে মুরগির রোস্ট। মেয়েটার পছন্দ পোলাও, মাংস ও মিষ্টি। যতই ঝগড়া করুক, একজন আরেকজনকে ছেড়ে থাকতে চায় না। পরস্পরকে খুব ভালোবাসে।
তিনি আরও বলেন, যতই কষ্ট হোক ওদের মুখের দিকে দেখলে সব কষ্ট ভুলে যাই। ওরা তো আমাদের অনেক কষ্ট ও অপেক্ষার প্রাপ্তি। ২০০৭ সালে আমার বিয়ে হয়। ৯ বছরেও সন্তান না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। চিকিৎসার পর ২০১৭ সালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যমজ ছেলে ও মেয়ের জন্ম হয়। মেয়ের নাম জারিন আইমান খান আর ছেলের নাম রেখেছি জারিফ আহম্মেদ খান। ওদের বয়স সাত বছর, পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে।
বদরগঞ্জ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণির শিক্ষক অনিতা রানী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এমন অনেক যমজ শিশুকে শিক্ষা দিয়ে আসছি। ক্লাসে তাদের আচরণ দু’জনেরই একই রকম হয়। বাথরুমে কেউ একজন যেতে চাইলে অন্যজনও যেতে চায়। তবে এই সুবিধাগুলো আমরা দিয়ে থাকি, কারণ আমরা ওদেরকে বুঝতে পারি।
বদরগঞ্জের শাহপাড়া গ্রামের মুকুল দাস ও শেলি রাণী দম্পতির যমজ মেয়ে বর্ণা ও বৃষ্টি। আদর করে ডাকেন হাসি ও খুশি নামে। ওরা দেখতে প্রায় একই রকম। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই বোনকে শনাক্ত করতে প্রায়ই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান শিক্ষকেরা।
দশ বছরের শিশু নিশাত মুনির ও এ এস এম মুনতাসির মুবিন। ওরা দুজন যমজ ভাই–বোন। বদরগঞ্জের বালুয়াভাটা গ্রামে বাড়ি। বিদ্যালয়ে ওই ভাই-বোনের খুনশুটি চোখে পড়ে। জানতে চাইলে নিশাত মুনির বলে, ‘ভাই আমার সঙ্গে খুব ঝগড়া লাগায়।’ এ সময় কথা টেনে বোনের দিকে আঙুল উঁচিয়ে মুবিন বলে, ‘আমি না, তুমিই বেশি ঝগড়া করো।’
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এখানে বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়ছে ৬০৭ শিশু। শিক্ষক আছেন ১৩ জন। রংপুর জেলায় ভালো ফলাফলের জন্য সুনাম থাকায় অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের এখানে ভর্তি করানোর ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। বছরে বছরে এখানে শিক্ষার্থীও বেড়ে যাচ্ছে।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মইনুল ইসলাম শাহ বলেন,
আমি গর্বিত এজন্য যে, অভিভাবকেরা তাদের শিশুদের অন্য প্রতিষ্ঠানে না দিয়ে আমার এখানে ভর্তি করেন। আমার বিদ্যালয়ে ২০ যমজ শিশু রয়েছ। এসব যমজ শিশুরা দেখতে অভিন্ন হওয়ায় কখনো কখনো ক্লাসে শনাক্ত করা মুশকিল হয়ে যায়। তবে যমজ শিশুদের ওদের সহপাঠী ছাড়াও অন্য শিশুরা বেশ পছন্দ করে। আমরা শিক্ষকেরাও তাদের প্রতি বাড়তি নজর রাখি।
তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক যমজ শিশুর অভিভাবক বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। তারা সন্তানের প্রতি খুব খেয়াল রাখে। অভিভাবকদের উপস্থিতিতে বিদ্যালয়ের পরিবেশ ভালো থাকে এবং বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমাদের যোগাযোগ হয়। প্রতিবছরই আমাদের শিশুরো ভালো ফলাফল করে আসছে।
বদরগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিক উজ জামান বলেন, এসব যমজ শিশুর প্রতি যেন বিশেষ নজর রাখা হয়, সেটি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি। শিশুদের ব্যাপারে মা-বাবার পক্ষ থেকে কোন পরামর্শ থাকলে শিক্ষকরা যেন সেটি গুরুত্বসহ দেখেন। কারণ যজম শিশুরা তো অন্যান্য সাধারণ শিশুর মতো না। ওদের নিয়ে তো মধুর বিড়ম্বনায় পড়েন শিক্ষকেরা।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বিকাশ মজুমদার বলেন, একটা পরিবারে দুটো শিশু। ওরা যমজ। এদের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা ও বিকাশে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। একসঙ্গে জন্ম হলেও এদের আচার–আচরণ, রুচিবোধ ও চাহিদা ভিন্ন হতে পারে। তবে যমজ শিশুরা পরস্পরের মধ্যে সহজেই বিনিময় করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমরা দুই ধরনের যমজ শিশু অর্থাৎ মনোজাইগোটিক টুইন ও ফ্র্যাটার্নাল বা ডাইজাইগোটিক টুইন দেখে থাকি। যখন দুটি বা ততোধিক শিশুর জন্ম হয় তাকে মনোজাইগোটিক টুইন বলা হয়। এ ধরনের শিশুদের আইডেনটিক্যাল টুইনও বলা হয়। সাধারণত এরা দেখতে একই রকম হয় বা উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য থাকে। এরা সাধারণত একই লিঙ্গের হয়ে থাকে। অর্থাৎ হয় দুটো ছেলে বা দুটো মেয়ে হবে। এদের গায়ের রং, চুল ও চোখের রং, রক্তের গ্রুপ সবই এক হয়ে থাকে। তবে এ ধরনের যমজ শিশুর সংখ্যা খুব একটা বেশি দেখা যায় না। অন্যদিকে ফ্র্যাটার্নাল বা ডাইজাইগোটিক টুইনের ক্ষেত্রে শিশুর লিঙ্গ এক হতেও পারে আবার নাও পারে। একটি ছেলে একটি মেয়ে হতে পারে। এরা দেখতে এক রকম হয় না। গায়ের রং বা রক্তের গ্রুপও আলাদা হতে পারে।
সূত্র: ঢাকাপোস্ট
ON/MRF