কাঁধে ধার দেওয়ার মেশিন নিয়ে চল্লিশ বছর ধরে ঘুরছেন আলী আহম্মদ

এক কাঁধে ‘দা’ শান দেওয়ার মেশিন, অন্য কাঁধে ঝোলানো হ্যান্ড মাইক—এভাবেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ান হবিগঞ্জের আলী আহম্মদ। ‘দা, বটি ধার করাবেন, কেঞ্চি সান দেওয়াবেন…’—হ্যান্ড মাইকে বাজতে থাকে তার ডাক। জীবিকার তাগিদে চল্লিশ বছর ধরে এভাবেই হাঁটছেন তিনি।
হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা আলী আহম্মদ সম্প্রতি সুনামগঞ্জ শহরের বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন। সামনে ঈদ উল ফিতর হওয়ায় তার কাজের ব্যস্ততাও বেড়েছে।
জীবিকার শুরু ও সংগ্রাম
আলী আহম্মদ জানান, ছোটবেলায় অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে যান। সেখানে এক বিহারীর সঙ্গে পরিচয় হয়, যার কাছেই তিনি ধার দেওয়ার কাজ শেখেন। প্রথমদিকে থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন তিন টাকা করে পেতেন। পরে কাজ শিখে প্রতিদিন ১০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে শুরু করেন। সেই ওস্তাদ চলে যাওয়ার সময় তার ব্যবহৃত মেশিনটি আলী আহম্মদকে দিয়ে যান।
এরপর থেকে প্রায় ৪০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ধার দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। আলী আহম্মদ বলেন, ‘এই কাজের জন্য আমাকে প্রচুর হাঁটতে হয়। যত বেশি এলাকায় হাঁটি, তত বেশি রোজগার হয়। হাঁটার কারণে শরীর সুস্থ থাকে, ডায়াবেটিস হয়নি।’
পরিবার ও জীবিকা
তার পাঁচ ছেলে, এর মধ্যে চারজনের বিয়ে দিয়েছেন। তিনজন আলাদা থাকেন, দুইজন এখনো তার সঙ্গে আছেন। সম্পদ যা ছিল, ছেলেরা নষ্ট করে ফেলেছে। কয়েকবার বিদেশ গেলেও কিছু করতে পারেনি।
দেশ ও বিদেশে কাজের অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি ভারতেও ধার দেওয়ার কাজ করেছেন তিনি। রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, বগুড়া, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় কাজ করেছেন। ভারতে কমলপুর, নালিছড়া, লাতাছড়া, কাঞ্চন বাড়ি, গোহাটি, আগরতলা, কলকাতা, মালদা, শিলিগুড়িসহ বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছেন। ‘আমি ভালো কাজ করি বলে মানুষজন আমার কাছে আসে,’ বলেন তিনি।
ঈদ মৌসুমে ব্যস্ততা ও আয়
রমজান ও কোরবানির ঈদে কাজের চাপ বেশি থাকে। সাধারণত দিনে ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা রোজগার হয়। তবে ঈদের সময়ে দুই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। বছরের এই সময়ে একবার সুনামগঞ্জে আসেন তিনি।
সন্তুষ্ট গ্রাহকরা
সুনামগঞ্জের উত্তর আরপিননগরের বাসিন্দা টুনু মিয়া বলেন, ‘অনেকদিন ধরে দা ধার দেওয়ার জন্য লোক খুঁজছিলাম। আজ হঠাৎ আলী আহম্মদকে পেয়ে দা ধার করালাম। আগেও কয়েকবার তার কাছ থেকে ধার করিয়েছি। তিনি ভালো কাজ করেন, দা-বটির ধরন বুঝে টাকা নেন। আমারটা ৮০ টাকা দিয়ে ধার করালাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আলী আহম্মদের মতো মানুষ এখন খুব একটা দেখা যায় না। ধার দেওয়া দা-বটি দিয়ে কাজ করা সহজ হয়, নতুন কেনার দরকার পড়ে না। একবার ধার দিলে অন্তত এক বছর নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যায়।’
–জাকারিয়া আহমদ, সুনামগঞ্জ
–ON/SMA