২১শে অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা: যেভাবে ঘটনার শুরু থেকে শেষ

২০০৪ সালের একুশে অগাস্টে ঢাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৪ জন – যে ঘটনা একুশে অগাস্টের গ্রেনেড হামলা হিসেবে পরিচিত।
ঘটনার দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা দুইটি মামলার রায় হয়েছিল ২০১৮ সালের ১০ই অক্টোবর।
ওই ঘটনার শুরু থেকে পরের ১৪ বছরের পরিক্রমায় সেসময় যা যা ঘটেছিল, চলুন জেনে নেয়া যাক…
ডেটলাইন ২১শে অগাস্ট ২০০৪
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশ হচ্ছিলো আওয়ামী লীগের উদ্যোগে। সমাবেশের প্রায় শেষ পর্যায়ে তাতে বক্তব্য রাখছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
একটি ট্রাকের ওপর তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে তিনি বক্তব্য দেবার সময় তাকে ঘিরে ছিলেন দলীয় নেতারা। আর সামনের দিক থেকে তার ছবি তুলছিলো অনেক ফটো সাংবাদিক।
বক্তব্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হয়। ঘটনাস্থলে ছবি তুলছিলেন ফটো সাংবাদিক জিয়াউল ইসলাম।
“এমন নৃশংসতা কখনো হতে পারে আমার কল্পনাতেও ছিলোনা। আমি মঞ্চেই ছিলাম। চেয়ারে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি আর ধাক্কায় চেয়ার থেকে নীচে পড়ে যাই। আমার ওপরে পড়ে অনেকে। হঠাৎ ট্রাকের পাটাতনের ফাঁকে চোখে পড়লো আস্ত গ্রেনেড। সেটি বিস্ফোরিত হলে কি হতো ভাবতেও শিউরে উঠি এখনো। শেখ হাসিনা কয়েক হাত দুরে। তাকে ঘিরে মানববর্ম তৈরি করেছেন তার দলের নেতারা। গ্রেনেডের শব্দ শেষে শুরু হলো গুলির শব্দ। এক পর্যায়ে উঠে দাঁড়াই এবং গুলি থামলে ট্রাক থেকে নেমে আসি। নামার পর যা দেখি সেটি আরেক বিভীষিকা। চারদিকে আর্তনাদ, গোঙ্গানি। রক্তাক্ত পড়ে আছে বহু নারী পুরুষ। কে জীবিত কে মৃত বোঝা মুশকিল। নিজে বেঁচে আছি বুঝতে পেরে আবার ক্যামেরার শাটারে ক্লিক করতে আরম্ভ করি”।
সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ জন আহত হন।
২০০৪ সালের একুশে অগাস্টে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহত আইভী রহমানের সাথেই ছিলেন নাসিমা ফেরদৌস।
তাঁর ভাষায় জোড়াতালি দেয়া হাত পা নিয়ে এখন বেঁচে আছেন তিনি।
বিবিসিকে তিনি বলেন, “আইভী আপা চিৎকার করে উঠলো। ধরতে চেষ্টা করলাম কিন্তু নিজেরই শক্তি নেই। বসে নিজেকে সরানোর চেষ্টা করলাম। আবার গ্রেনেডের শব্দ।পেটের ভেতর ঢুকে গেলো স্প্রিন্টার। কাপড় পুড়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পেলাম আমার পা ছিড়ে চলে যাচ্ছে”।
“নিজের হাত-পা-গুলো একত্রিত করলাম। জ্ঞান হারাই। পরে জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি লাশের ট্রাকে। আমি চিৎকার করলাম। পরে মর্গে না দিয়ে ঢাকা মেডিকেলের করিডোরে নিয়ে ফেললো। আমি এখন ক্ষত-বিক্ষত। জোড়াতালি দেয়া হাত পা নিয়ে বেঁচে আছি”।
অথচ এই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো প্রত্যাশিত বিচার পাননি নিহতদের পরিবার কিংবা আহতরা।
যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসিকে বলেছেন খুব শীঘ্রই শেষ হবে বিচার প্রক্রিয়া, আসবে মামলার রায়।
তিনি বলেন, “আমি যখন মন্ত্রী হলাম তখন ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য হয়েছিলো। আর এখন ২২৪তম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে। এরপর চূড়ান্ত তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ পর্যায়ে। এরপর আসামীদের জবানবন্দী নেয়া হবে ও যুক্তি তর্ক হবে। আমি আশা করি দ্রুততম সময়েই এ মামলার রায় হবে”।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২০০৪ সালে ওই হামলায় নিহত হয়েছিলো ২৪ জন এবং আহত হয়েছিলো বহু মানুষ।
ঘটনাস্থলে শেখ হাসিনার মঞ্চেই দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন ফটো সাংবাদিক জিয়া ইসলাম।
তিনি বলেন ট্রাকের ওপর নির্মিত অস্থায়ী মঞ্চে বক্তব্য মাত্রই শেষ করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আরও কিছু ছবির আশায় তিনিসহ অন্য ফটোসাংবাদিকরা ছিলেন সেখানে। আর মূহুর্তেই গ্রেনেড হামলা। নীচে পড়ে যান তিনি।
“আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম, তখন ভয়ঙ্কর একটা অবস্থা চারদিকে। বিভিন্ন দিকে লোকজন পড়ে আছে। রক্তাক্ত, আর্তনাদ, মানুষের বাঁচার আর্তি। ভয়ংকর অবস্থা ছিলো সেদিন”-বলছিলেন জিয়া ইসলাম।
যদিও ঘটনার পর থেকেই এ মামলার তদন্ত নিয়ে হয়েছে নানা বিতর্ক।
ঘটনার পর বিচার বিভাগীয় কমিশন হয়েছে, যার রিপোর্ট পরে আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
সমালোচনা হয়েছে জজ মিয়া নামে একজনকে দিয়ে স্বীকোরোক্তি আদায়ের চেষ্টাও।
পরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আবার তদন্ত শুরু হয়।
২০০৮ সালে আদালতে দুটি অভিযোগপত্র দেয়া হয় যাতে বিএনপি সরকারের একজন উপমন্ত্রী, তার ভাইসহ ২২ জনকে আসামী করা হয়।
পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আদালতের অনুমতি নিয়ে অধিকতর তদন্ত হয়।
এ তদন্তের পর আসামী করা হয় বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরও ত্রিশ জনকে।
যদিও অধিকতর তদন্তের পর বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজনের নাম আসার পর সেটি প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করেছে।
যদিও মন্ত্রী বলছেন নিরপেক্ষ তদন্তেই তাদের নাম এসেছে।
তবে বিতর্ক যাই হোক নিহতদের পরিবার ও আহতরা চান দ্রুতই শাস্তি হোক জঘন্যতম ওই হামলায় জড়িতদের।
-সূত্রঃ বিবিসি বাংলা
–ON/SMA