২৮ বছর একাকী জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন জাপানি সেনা, জানতেন না বিশ্বযুদ্ধ শেষ

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্কিন টেরিটোরি গুয়াম দ্বীপপুঞ্জে মুখোমুখি জাপানি আর মার্কিন বাহিনী। মার্কিন সেনাদের তুমুল আক্রমণের মুখে রীতিমতো পর্যুদস্ত জাপানিরা। গুয়ামের গহিন জঙ্গলে কয়েকজন সঙ্গীসহ লুকিয়ে পড়লেন জাপানের রাজকীয় বাহিনীর ল্যান্স করপোরাল শোইচি ইয়োকোই।
এরপর ঘটে গেছে অদ্ভুত এক ঘটনা। গহিন জঙ্গলে শোইচিকে খুঁজে পাওয়া গেল ১৯৭২ সালের আজকের দিনে (২৪ জানুয়ারি)। তত দিনে প্রায় ২৮ বছর পেরিয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে দুটি পারমাণবিক বোমার আঘাত বুকে নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে জাপানিরা। এমনকি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে যাত্রাও শুরু করেছে জাপান।
এসবের কিছুই জানতেন না শোইচি। যুদ্ধের আঘাত থেকে বাঁচতে জঙ্গলের গহিনে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। তাও একাকী। ভেবেছিলেন, ধরা পড়লে মার্কিনিদের হাতে যুদ্ধবন্দী হতে হবে। এটা তাঁর নিজের ও পরিবারের জন্য, সর্বোপরি দেশের জন্য চরম অবমাননাকর হবে। তার চেয়ে বনবাস ভালো।
আজ থেকে ঠিক ৫৩ বছর আগে, ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি গুয়ামের গহিন জঙ্গলে স্থানীয় শিকারিরা শোইচিকে খুঁজে পান। তত দিনে তাঁর বয়স হয়েছে ৫৭ বছর। পরে ‘যুদ্ধের নায়ক’ হিসেবে সংবর্ধনা দিয়ে জাপানে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তাঁকে। যদিও তিনি জাপানের আধুনিক জীবনে কখনোই অভ্যস্ত হতে পারেননি। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি।
যদিও শোইচির মনের কোণে আশা ছিল, একদিন নিশ্চয়ই তাঁর সাবেক কমরেডরা আসবেন। খুঁজে বের করবেন তাঁকে। দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।
আজ থেকে ঠিক ৫৩ বছর আগে, ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি গুয়ামের গহিন জঙ্গলে স্থানীয় শিকারিরা শোইচিকে খুঁজে পান। তত দিনে তাঁর বয়স হয়ে গেছে ৫৭ বছর। পরে ‘যুদ্ধের নায়ক’ হিসেবে সংবর্ধনা দিয়ে জাপানে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তাঁকে। যদিও তিনি জাপানের আধুনিক জীবনে কখনোই অভ্যস্ত হতে পারেননি। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি।
শোইচি ইয়োকোইয়ের জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার সময়। ১৯১৫ সালের ৩১ মার্চ জাপানের আইচি প্রদেশের শাওরিতে। অর্থাৎ গত শতকের দু–দুটি বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী তিনি। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি জাপানের রাজকীয় সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন।
দুর্বল ও আতঙ্কিত ছিলেন
শোইচি ইয়োকোইকে গহিন জঙ্গল থেকে উদ্ধারের প্রসঙ্গে তাঁর ভাইপো অমি হাতাশিন বলেন, ওই সময় ভীষণ আতঙ্কিত ছিলেন শোইচি।
গহিন জঙ্গলে এত বছর পুরোপুরি একা থাকার পর একসঙ্গে এত মানুষ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন শোইচি। সঙ্গে থাকা একটি শিকারের রাইফেল হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবারের অভাবে ভীষণ দুর্বল আর শীর্ণ হয়ে পড়েছিলেন—এমনটাই বলেন হাতাশিন।
হাতাশিন আরও বলেন, ‘তিনি (শোইচি) ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, লোকেরা তাঁকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরে নিয়ে যেতে এসেছেন। এটা একজন জাপানি সেনা ও তাঁর পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জার বিষয় হতো।’
অর্থাৎ উদ্ধারের সময়ও শোইচি জানতেন না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় ২৮ বছর হয়ে গেছে। তিনি বনবাসের দিনগুলোয় বাইরের বিশ্ব সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে ছিলেন।
অভিজ্ঞতা থেকে বই
উদ্ধার করার বছর দুয়েক পর শোইচির অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়। জাপানি ভাষায় প্রকাশিত বইটিতে উদ্ধারকারীদের অভিজ্ঞতার বয়ানও আছে। তাঁদের সবার কাছ থেকে গল্পগুলো শুনে শুনে বইটি লিখেছেন হাতাশিন।
২০০৯ সালে এসে শোইচির ওই বই ইংরেজি ভাষাতেও প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘প্রাইভেট ইয়োকোই’স ওয়ার অ্যান্ড লাইফ অন গুয়াম, ১৯৪৪-১৯৭২’।
হাতাশিন বলেন, ‘আমি তাঁকে (শোইচি) নিয়ে গর্ববোধ করি। তিনি লাজুক ও শান্তশিষ্ট একজন মানুষ ছিলেন। তবে তাঁর উপস্থিতি ছিল দুর্দান্ত।’
রোগে-শোকে-ক্ষুধায় একের পর এক সঙ্গী হারাতে শুরু করেন শোইচি। সর্বশেষ দুজন সঙ্গী ছিলেন তাঁর। তাঁরাও ১৯৬৪ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় প্রাণ হারান। এরপর পুরোপুরি একা হয়ে পড়েন শোইচি। তখন থেকে উদ্ধার হওয়ার সময় পর্যন্ত তাঁকে প্রায় আট বছর গহিন জঙ্গলে একাকী কাটাতে হয়েছে।
ব্যাঙ-ইঁদুর খেয়ে টিকে ছিলেন
গুয়ামে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে জাপানি সেনাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় মার্কিনিরা। এ কারণে জাপানিদের প্রতিরোধব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। শুরু হয় শোইচির দীর্ঘদিনের অগ্নিপরীক্ষা।
লড়াই এতটাই ভয়াবহ আর উভয় পক্ষে হতাহতের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে বিপর্যয় এড়াতে শোইচির ওপর তাঁর প্লাটুন রক্ষার দায়িত্ব পড়ে। তত দিনে সেখানে জাপানিদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে। শোইচিরা জঙ্গলের দিকে সরে যান।
হাতাশিন লিখেছেন, ‘পালিয়ে থাকা জাপানি সেনারা শুরু থেকেই ধরা না পড়ার বিষয়ে বেশ সতর্ক ছিলেন। চলার সময় তাঁরা নিজেদের পায়ের ছাপ মুছে ফেলতেন।’
শুরুর দিকে জাপানি সেনারা স্থানীয় লোকজনের পশু ধরতেন। পরে মেরে খেতেন। দ্রুত সেনাদের সংখ্যা কমে আসতে থাকে। অচিরেই তা মাত্র কয়েক ডজনে নেমে আসে।
তবে মার্কিন বাহিনীর টহল ও স্থানীয় শিকারিদের কারণে পালিয়ে থাকা জাপানি সেনারা গুয়ামের ঘন জঙ্গলের আরও গহিনে চলে যান। তখন তাঁদের খাবার ছিল ব্যাঙ, নদীর ইল আর ইঁদুর। এসব ব্যাঙের কিছু কিছু বিষাক্ত ছিল।
নদী থেকে ইল ধরার জন্য ফাঁদ বানিয়ে নিয়েছিলেন শোইচি। নিজের জন্য তিনি ভূগর্ভে নিরাপদ আশ্রয় বানিয়েছিলেন। শক্ত বাঁশ দিয়ে এটা বানানো হয়েছিল। হাতাশিন বলেন, ‘তিনি (শোইচি) বেশ দক্ষ একজন মানুষ ছিলেন।’
হাতাশিন আরও বলেন, ‘গহিন জঙ্গলে টিকে থাকতে অনেক বেশি ভাবতে হতো শোইচিকে। তাই পরিবার নিয়ে ভাবার খুব একটা সময়-সুযোগ পেতেন না তিনি। এমনকি নিজের দুর্দশা নিয়েও ভাবার অবকাশ পেতেন কম।’
আট বছর একাকী ছিলেন
রোগে-শোকে-ক্ষুধায় একের পর এক সঙ্গী হারাতে শুরু করেন শোইচি। সর্বশেষ দুজন সঙ্গী ছিলেন তাঁর। তাঁরাও ১৯৬৪ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় প্রাণ হারান। এরপর পুরোপুরি একা হয়ে পড়েন তিনি। তখন থেকে উদ্ধার হওয়ার সময় পর্যন্ত তাঁকে প্রায় আট বছর গহিন জঙ্গলে একাকী কাটাতে হয়েছে।
জঙ্গলে একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন শোইচি। ভেবেছিলেন, এবার বুঝি মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হবে। তখনো নিজের অবস্থান নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন এই সেনা। শোইচির ভাষায়, ‘না, আমি এখানে মরতে পারি না। আমি আমার মরদেহ শত্রুর কাছে প্রকাশ করতে পারব না। মৃত্যুবরণের আগে আমাকে অবশ্যই গর্তে ফিরে যেতে হবে। এখন পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকতে পেরেছি, কিন্তু এখন সবকিছুই ব্যর্থ হতে যাচ্ছে।’
উদ্ধার হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক পর শোইচিকে জাপানে ফিরিয়ে আনা হয়। নিজ দেশের জনগণের পক্ষ থেকে একজন ‘বীর’ হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয় তাঁকে।
দেশে ফিরে ব্যস্ততা বাড়ে
জাপানে ফিরে আসার পর শোইচির ব্যস্ততা বেড়ে যায়। টিভি আর রেডিও চ্যানেলগুলোয় একের পর এক সাক্ষাৎকার দিতে থাকেন তিনি। দেশজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে ডাকা হয় তাঁকে।
তবে আধুনিক জাপানের ব্যস্ত জীবনে কখনোই স্বাচ্ছন্দ্য হতে পারেননি শোইচি। এ বিষয়ে হাতাশিন বলেন, ‘বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে জাপানের দ্রুত বিকাশমান অর্থনৈতিক অগ্রগতি তাঁকে মুগ্ধ করতে পারেনি। একদিন ১০ হাজার ইয়েনের নতুন একটি ব্যাংকনোট দেখে তিনি (শোইচি) “এটা এখন মূল্যহীন” বলে মন্তব্য করেন।’
নিজের ফেলে আসা জীবন নিয়ে ভীষণ নস্টালজিয়ায় ভুগতেন শোইচি, এমনটা জানান হাতাশিন। তিনি বলেন, নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গুয়ামে গিয়েছিলেন শোইচি। গুয়াম দ্বীপপুঞ্জের জাদুঘরে এখনো তাঁর বানানো ইল ধরার ফাঁদ, ছবিসব বেশকিছু নিদর্শন সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাপানের নাগোয়াতে ৮২ বছর বয়সে মারা যান শোইচি।
সুত্র: প্রথম আলো
ON/RMN