কৃষকদের ক্ষতি: ইউক্যালিপটাসের অতিমাত্রায় পানি শোষণ

বাংলাদেশের পরিবেশ ও মাটির উর্বরতা রক্ষার জন্য ইউক্যালিপটাস গাছের রোপণ সীমিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন। ইউক্যালিপটাস, যা সারা বিশ্বে প্রায় ৭০০ প্রজাতিতে বিদ্যমান, পরিবেশে বিভিন্ন বিরূপ প্রভাব ফেলে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ৪৫ লাখ টন ইউক্যালিপটাস কাঠের ফালি আসবাবপত্রের কাজে রফতানি করা হয়, যা থেকে বছরে প্রায় ২৫ কোটি মার্কিন ডলার আয় হয়। এই গাছ থেকে তেল ও ট্যানিন পাওয়া যায়, যা অ্যান্টিসেপটিক ও পরিষ্কারক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং মশা নিধনেও ভূমিকা রাখে।
তবে, ইউক্যালিপটাস মাটি থেকে অতিমাত্রায় পানি শোষণ করে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটায়। বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে এই গাছের ব্যাপক রোপণ হচ্ছে। একটি ইউক্যালিপটাস গাছ তার আশপাশের প্রায় ১০ ফুট এলাকার ও ভূগর্ভের প্রায় ৫০ ফুট নিচের পানি শোষণ করে, যা মাটিতে পানিশূন্যতা সৃষ্টি করে এবং অন্যান্য গাছের জন্ম বাধাগ্রস্ত করে। মাটির উর্বরতা কমে যায় এবং শুষ্কতা বাড়ে।
গাছটি কেটে ফেলা হলেও মাটির উর্বরতা ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। ইউক্যালিপটাসের পাতায় থাকা অ্যান্টিসেপটিক কারণে নিচে ছোট গাছ জন্মাতে পারে না এবং পোকামাকড় মারা যায়। এর ফল ও ফুল বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের শ্বাসনালীতে শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের সৃষ্টি হতে পারে। পরিবেশ ও মাটির বিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশের জলবায়ুর জন্য ইউক্যালিপটাস অত্যন্ত বিপদজ্জনক।
বাংলাদেশে এক সময়ে সরকারি কর্মসূচির আওতায় ইউক্যালিপটাস রোপণ করা হয়েছিল, বিশেষ করে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে। তবে ২০০৮ সালে একটি বিজ্ঞপ্তিতে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় এবং বনবিভাগের উৎপাদন বন্ধের নীতি গ্রহণ করা হয়। তারপরও, পূর্বে রোপিত ইউক্যালিপটাস গাছ এখনও বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
হাতীবান্ধা উপজেলার সিংগীমারি ইউনিয়নের কৃষক ওহেদ আলী (৬৫) জানান, ‘আমার ১০০ শতকের জমির মধ্যে পাশের জমির মালিক ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণ করেন। ফলে আমার জমিতে কোন ফসল হয় না। গেলোবার সরিষা চাষ করেছিলাম ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এইজন্য জমিটা কোন কাজে ব্যবহার করতে পারছি না এবং আমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ ব্যাপারে আমি কৃষি অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি আমাকে সাহায্যের জন্য আশ্বস্ত করেছেন।’
হাতীবান্ধা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কার্তিক কুমার বলেন, ‘একটি পরিপক্ক ইউক্যালিপটাস গাছ দিনে ২২ মন পানি গ্রহণ করে। এই গাছের পাতা কোন জমিতে পড়লে সেই জমিতে কোন ফসল হয় না। যদি কোন ফসোলী জমির মাঝে এই গাছ থাকে এবং কৃষক লিখিত অভিযোগ জানান, তাহলে সরজমিন পরিদর্শন করে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বনবিভাগকে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছ না লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বন বিভাগ আর ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছ রোপণ করবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বায়োডাইভারসিটি রুলস ও গাইডলাইন তৈরির কথা জানিয়ে লাঠি টিলা, চুনতি, সাতছড়ি ও লাউয়াছড়ার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করতে হবে।’
বাংলাদেশের পরিবেশ ও মাটির উর্বরতা রক্ষার জন্য ইউক্যালিপটাস গাছের রোপণ সীমাবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ইউক্যালিপটাসের বিরূপ প্রভাব থেকে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব।
-সাব্বির হোসেন, লালমনিরহাট
ON/RMN