বাঁশের তৈরি সারি সারি চাঙ ও মাচাঙ। তার কোনোটিতে লইট্ট্যা-ফাইশ্যা; কোনোটিতে হাঙর, অসসহ নানা জাতের মাছ। এসব মাছ শুকাতে ব্যস্ত হাজারো নারী-পুরুষ। শীত মৌসুমে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন পাড়ে প্রতিদিন এ দৃশ্য খুব সাধারণ। যেন শুঁটকি তৈরির ধুম পড়েছে। নদীপাড়ের বাতাসে কেবলই শুঁটকির ঘ্রাণ।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ভোজনপ্রিয় বাঙালির প্লেটে পছন্দ ও স্বাদের শুঁটকি তুলে দিতেই শীত মৌসুমে টানা কয়েক মাস চলে এমন কর্মযজ্ঞ। আবহাওয়াজনিত কারণে কর্ণফুলীর তীরে প্রক্রিয়াজাত শুঁটকির স্বাদ ও গুণগত মানে অনন্য। এ সময় বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে। এ জন্য কাঁচা মাছকে দ্রুত শুঁটকিতে পরিণত করা যায়। এবার কর্ণফুলী নদীর ইছানগর, ডাঙ্গারচর, ফিসারি ঘাট, কর্ণফুলী ঘাট, বাকলিয়া, রাজাখালী, চাক্তাই, চর চাক্তাইসহ বিভিন্ন পাড়ে চলছে শুঁটকি তৈরির কাজ। আগামী তিন থেকে চার মাস এ কর্মযজ্ঞ চলবে।
প্রতিদিন সূর্যের আলোয় ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছ শুকানো হয়। নদীরপাড় থেকে শুঁটকি চলে যায় পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, চাক্তাইসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা মোকামে। অনেকে আবার নদীরপাড় থেকেই ইচ্ছেমতো পছন্দের শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। চট্টগ্রাম মহানগরের পাশাপাশি ১৫ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকেও অনেকে শুঁটকি কিনতে আসেন এসব মোকামে।
সরেজমিন কর্ণফুলীর কয়েকটি পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফুটতেই নারী-পুরুষ দলে দলে নদীপাড়ে আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের কেউ রোদে মাছ দিচ্ছেন, কেউ আবার অর্ধেক শুকানো শুঁটকি রোদ লাগার জন্য ওলটপালট করছেন। একদল বিভিন্ন জাতের মাছের পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করছে, অন্যদল সেগুলো ভালো করে ধুয়ে পরিস্কার করছে। এরপর মাছগুলো চাঙ ও মাচাঙে সারিবদ্ধভাবে দিচ্ছেন অন্যরা। ধীরে ধীরে তকতকে রোদে মাছ পুরোপুরি শুকিয়ে হয়ে যাচ্ছে স্বাদের শুঁটকি।
শুঁটকি তৈরির শ্রমিক জমির উদ্দিন জানান, শীত ছাড়া ভালোমানের শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব নয়। শীত যত বাড়বে, শুঁটকির চাহিদাও বাড়বে। এ জন্য শীতের কয়েক মাস তাঁদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। আরেক শ্রমিক এলিনা বেগম জানান, প্রখর রোদে শুঁটকির কাজ করা কষ্টের। তবে কাজ বেশি থাকায় আয় বেশি হচ্ছে বলে তা খুব একটা মনে থাকে না।
কীটনাশক ছাড়াই প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত এখানকার শুঁটকি দেশ-বিদেশে চাহিদা রয়েছে। শীত মৌসুমে টানা তিন থেকে চার মাস কর্ণফুলীপাড়ে চলে এ কর্মযজ্ঞ। কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, টেকনাফসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে মানুষ শুঁটকি কিনতে কর্ণফুলীপাড়ে আসেন।
আছদগঞ্জের মেসার্স আলমগীর ব্রাদার্সে শুঁটকি কিনতে আসা ষাটোর্ধ্ব প্রণব বড়ূয়া জানান, তাঁর পরিবারের ছোট-বড় সবার প্রিয় খাবার শুঁটকির তৈরি নানা পদ। প্রতি বেলায় শুঁটকির পদ তাঁদের দিতেই হবে। এ জন্য পছন্দের শুঁটকি কিনতে এখানে এসেছেন বলে জানান তিনি।
আছদগঞ্জ পল্লির শুঁটকি বিক্রেতা মো. আলমগীর বলেন, ‘শীতে এখানে কোটি টাকার শুঁটকি বিকিকিনি হয়। দূরের অনেক এলাকা থেকেও ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। শীতের প্রকোপ যত বাড়বে, জমবে শুঁটকি তৈরি ও বিনিকিনি।’